Subscribe Us

সততা ও নৈতিকতা: মানুষের প্রকৃত সম্পদ

 

ভূমিকা

মানুষের জীবনে এমন কিছু গুণ আছে যা কখনও পুরনো হয় না। যুগে যুগে, দেশে দেশে—সব সংস্কৃতিতেই কিছু শব্দ মানুষের চরিত্র গঠনে আলো ছড়িয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সততা এবং নৈতিকতা

টাকা-পয়সা, সম্পদ বা খ্যাতি ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু সততা ও নৈতিকতা হলো সেই সম্পদ যা হারায় না, ভাঙে না, শেষ হয় না। এগুলো মানুষকে মানুষের কাছে সম্মানিত করে তোলে এবং সমাজে আস্থা তৈরি করে।

আজ আমরা একটি ছোট্ট ছেলের গল্পের মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করব, কিভাবে সততা ও নৈতিকতা মানুষের জীবনে আলোর প্রদীপ হয়ে জ্বলে ওঠে।


আমানের গল্প

অমান নামের একটি ছেলে ছিল। বয়স মাত্র বারো বছর। সে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিল। তার বাবা ছিলেন দিনমজুর, সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পরও সংসারের খরচ মেটানো যেত না। মা ঘরে বসে কাপড় সেলাই করতেন, সামান্য উপার্জন হতো তাতে।

অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। কিন্তু অভাবের মাঝেও অমানের বাবা-মা তাকে এক শিক্ষা দিয়েছিলেন:
“বেটা, যত কষ্টই হোক না কেন, সততা কখনও ছাড়বে না। সততা হলো গরিবের আসল ধন।”

প্রতিদিন ভোরে অমান কাছের জঙ্গলে যেত। শুকনো কাঠ কুড়িয়ে আনত, তারপর বাজারে বিক্রি করে চাল-ডাল কিনে আনত। এভাবেই চলত তাদের দিন।

একদিন অমান জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গিয়ে হঠাৎ একটি পুরোনো চামড়ার থলি পেল। কৌতূহল নিয়ে থলি খুলতেই অবাক হয়ে গেল সে—ভেতরে ঝকমক করছে সোনার মোহর!

অমান কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল। মাথায় ঘুরতে লাগল নানা চিন্তা।
“এই সোনা দিয়ে আমি কত কিছু করতে পারি! নতুন জামা, খেলনা, খাবার—সব পাওয়া যাবে। এমনকি একটা ভালো ঘরও বানানো যাবে।”

কিন্তু তখনই বাবার শেখানো কথা মনে পড়ল:
“সততা হারালে সব হারাবে। সোনা থাকবে না, কিন্তু সততা থাকলে সম্মান চিরদিন থাকবে।”

অমান থলি শক্ত করে বেঁধে বাজারে গেল। সবার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলল:
“কে সোনার এই থলি হারিয়েছেন? দয়া করে আসুন। যে এর মালিক, সে যেন এর বর্ণনা দেয়।”

লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলল: “পাগল ছেলে! এত সোনা পেয়েও ফেরত দিতে চাইছে!” কেউ আবার হাসল।

হঠাৎ এক বৃদ্ধ কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এলেন। চোখে অশ্রু, কণ্ঠে ব্যাকুলতা। তিনি থলির সঠিক বর্ণনা দিলেন—তার রঙ, দড়ির দাগ, কয়টা সোনার মোহর আছে, সব।

বৃদ্ধ থলি হাতে পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন:
“বাবা, এই সোনা আমার সারা জীবনের সঞ্চয়। আমি ভেবেছিলাম আর পাব না। তুমি আমার জীবন রক্ষা করলে।”

তিনি অমানকে থলির অর্ধেক সোনা দিতে চাইলেন পুরস্কার হিসেবে।

কিন্তু অমান মৃদু হাসি দিয়ে বলল:
“না কাকা, আমি কোনো পুরস্কার চাই না। আমি এটা ফিরিয়েছি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।”

বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে তার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন:
“আল্লাহ তোমাকে সুখ, সম্মান আর সফলতা দান করুন। তুমি প্রমাণ করলে, এই দুনিয়ায় এখনও সৎ মানুষ বেঁচে আছে।”

অমান সেদিন বাড়ি ফিরল শুধু কাঠের গাদা নিয়ে। কিন্তু আসলে সে ফিরেছিল অনেক বড় সম্পদ নিয়ে—সততা ও নৈতিকতার শক্তি



আমানের গল্প থেকে শিক্ষণীয় বিষয়

১. সততা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে না
অমান সহজেই সোনা রেখে দিতে পারত, কেউ জানতও না। কিন্তু প্রকৃত সততা হলো সেই গুণ, যা লুকানো অবস্থাতেও আপনাকে সঠিক পথে চালায়।

২. নৈতিকতা অর্থের চেয়ে বড় সম্পদ
সোনা-মোহর শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু নৈতিকতার খ্যাতি থাকবে চিরকাল।

৩. পুরস্কার ক্ষণস্থায়ী, সততা চিরস্থায়ী
অমান পুরস্কার নিল না। কারণ তার কাছে আল্লাহর সন্তুষ্টিই সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

৪. সততা অন্যকে অনুপ্রাণিত করে
বৃদ্ধ যেমন কেঁদে দোয়া করেছিলেন, তেমনি আশেপাশের মানুষও প্রভাবিত হয়েছিল। একজনের সততা বহুজনের হৃদয়ে আলো ছড়ায়।


দৈনন্দিন জীবনে সততা ও নৈতিকতা

আমাদের জীবনে প্রতিদিনই ছোট-বড় নানা পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়।

  1. কর্মক্ষেত্রে: দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা, ঘুষ না নেওয়া।
  2. বিদ্যালয়ে: নকল না করা, নিজের জ্ঞান দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া।
  3. ব্যবসায়ে: গ্রাহকের সাথে প্রতারণা না করা, সঠিক দাম নেওয়া।
  4. সম্পর্কে: সত্য কথা বলা, প্রতিশ্রুতি রাখা।

এগুলোই হলো নৈতিক জীবনের অংশ।


কেন আজ সততা দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে?

আধুনিক সমাজে প্রতিযোগিতা, লোভ আর ভোগবাদের কারণে মানুষ দ্রুত সাফল্যের জন্য অসৎ পথে ঝুঁকে পড়ে। অনেকে ভাবে, “সবাই যখন করছে, আমিও করব।”

কিন্তু এর ফল ভয়াবহ। আস্থা ভেঙে যায়, সম্পর্ক দুর্বল হয়, সমাজে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। তাই সততা ও নৈতিকতা ছাড়া শান্তিপূর্ণ সমাজ কল্পনাই করা যায় না।


সততার অদৃশ্য পুরস্কার

অমান সোনা নিল না, কিন্তু সে কী পেল?

১. মনের শান্তি – নির্ভয়ে ঘুমাতে পারা সবচেয়ে বড় সুখ।
2. বিশ্বাস – মানুষ তাকে আজীবন সৎ বলে মনে রাখবে।
3. দোয়া ও আশীর্বাদ – বৃদ্ধের চোখের পানি আর দোয়া তার জীবনের মূলধন হয়ে থাকবে।
4. অভ্যন্তরীণ শক্তি – একবার সততার পরীক্ষা উত্তীর্ণ হলে পরেরবার আরও শক্তিশালী হওয়া যায়।


ইতিহাসে সততা ও নৈতিকতার দৃষ্টান্ত

  1. প্রবhet মুহাম্মদ (সা.) – যাকে বলা হতো আল-আমিন অর্থাৎ বিশ্বস্ত।
  2. আব্রাহাম লিংকন – আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, যিনি “Honest Abe” নামে পরিচিত ছিলেন।
  3. মহাত্মা গান্ধী – যিনি সত্য ও অহিংসার মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়েছিলেন।

তাঁদের জীবন প্রমাণ করে, মহত্ত্ব আসে নৈতিকতা থেকে।



কিভাবে সততা ও নৈতিকতা গড়ে তুলবেন?

১. ছোট থেকে শুরু করুন – অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেওয়া, মিথ্যা না বলা।
২. নিজেকে প্রশ্ন করুন – আমি এটা কি শুধুই লাভের জন্য করছি, নাকি সঠিক বলেই করছি?
৩. একতা বজায় রাখুন – পরিস্থিতি যেমনই হোক, নীতিতে ছাড় দেবেন না।
৪. ভালো মানুষের সঙ্গ নিন – সৎ বন্ধু সৎ পথে চালায়।
৫. জবাবদিহিতা মনে রাখুন – আল্লাহর কাছে সবকিছুর হিসাব দিতে হবে।


উপসংহার

অমান সেদিন কাঠ নিয়ে ফিরলেও সে ফিরেছিল আরও বড় সম্পদ নিয়ে—সততা ও নৈতিকতার অমূল্য ধন

এই দুনিয়ায় লোভ, প্রলোভন আর প্রতারণা অনেক। তবু সত্য ও সততার পথ বেছে নেওয়াই প্রকৃত বিজয়। টাকা-পয়সা ঝলমল করে, কিন্তু সততার আলো তার চেয়ে উজ্জ্বল।

সততা অমর। নৈতিকতা অক্ষয়।

চলুন, আমরা অমানের মতো জীবনের প্রতিটি ধাপে সততা ও নৈতিকতার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখি। কারণ এটাই সেই সম্পদ, যা কখনও হারায় না, আর যা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মহান করে তোলে।


Post a Comment

0 Comments