Subscribe Us

আল্লাহর ভরসা : হযরত ইবরাহীম (আ.) এর কাহিনী


প্রস্তাবনা

মানুষের জীবন সংগ্রাম, ধৈর্য ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। ইসলামে নবী-রাসূলদের জীবনী কেবল ইতিহাস নয়, বরং শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার ভাণ্ডার। আজ আমরা শুনবো হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর এক বিস্ময়কর কাহিনী। তিনি “খলিলুল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদেরকে শেখায়—আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখলে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব।


জন্ম ও শৈশব

হযরত ইবরাহীম (আ.) জন্ম নেন ইরাকের বাবেল অঞ্চলে। সেই সময়ের সমাজ ছিলো মূর্তিপূজায় নিমগ্ন। চারপাশে মানুষ নানা আকৃতির পাথর ও কাঠের মূর্তি বানিয়ে তাদের পূজা করত। তাঁর পিতা আযার ছিলেন রাজকীয় ভাস্কর, যিনি নিজ হাতে মূর্তি গড়তেন এবং লোকজনকে তা পূজা করতে উৎসাহ দিতেন।

কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ইবরাহীম (আ.) সত্যের খোঁজ করতেন। তিনি বুঝতে পারতেন না, মানুষ কীভাবে নিজের হাতে বানানো জড়বস্তু পূজা করতে পারে। তিনি প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতেন—এই বিশাল আকাশ, চাঁদ, সূর্য কে সৃষ্টি করেছে? নিশ্চয়ই এর পেছনে আছেন এক মহান স্রষ্টা।


সত্যের সন্ধান

একদিন ইবরাহীম (আ.) চাঁদ দেখে বললেন:
“হয়তো এটাই আমার রব।”

কিন্তু ভোর হলে যখন চাঁদ মিলিয়ে গেল, তিনি বললেন:
“না, যে হারিয়ে যায়, সে তো রব হতে পারে না।”

এরপর সূর্য দেখে বললেন:
“এটাই হয়তো আমার রব।”

কিন্তু সূর্যও অস্ত গেলে তিনি বললেন:
“আমি তাদের ভালোবাসি না, যারা হারিয়ে যায়। আমার রব হচ্ছেন সেই মহান স্রষ্টা, যিনি সবকিছুর স্রষ্টা এবং যিনি কখনো অদৃশ্য হন না।”

এইভাবেই ইবরাহীম (আ.) একমাত্র আল্লাহর পরিচয় পান এবং ঘোষণা করলেন—“আমার রব হলেন আল্লাহ, এক এবং অদ্বিতীয়।”


মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

ইবরাহীম (আ.)-এর পিতা আযার তাঁকে অনেকবার সতর্ক করলেন—“আমার কাজের বিরুদ্ধে কথা বলো না। মূর্তিই আমাদের উপাস্য।”

কিন্তু ইবরাহীম (আ.) দৃঢ়ভাবে বললেন:
“পিতা, আপনি যা করছেন তা ভুল। এই মূর্তিগুলো কারো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। কেবল আল্লাহই আমাদের উপকার করতে পারেন।”

পিতার চোখে এটা ছিলো অবাধ্যতা। কিন্তু ইবরাহীম (আ.) সত্যকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।


রাজা নমরূদের সামনে দ্বন্দ্ব

সেই সময়ের শাসক ছিলেন এক অত্যাচারী রাজা—নমরূদ। সে দাবি করতো, “আমি-ই মানুষকে জীবন-মৃত্যু দিই। আমিই সবার প্রভু।”

ইবরাহীম (আ.) তাঁকে বললেন:
“আমার রব হলেন আল্লাহ, যিনি জীবন দেন এবং মৃত্যু দেন।”

নমরূদ গর্বভরে দু’জন মানুষকে হাজির করলো। একজনকে মুক্তি দিল, আরেকজনকে হত্যা করলো। বলল:
“দেখো, আমিও জীবন দিই, মৃত্যু দিই।”

ইবরাহীম (আ.) শান্তভাবে বললেন:
“আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উঠান। তুমি যদি সত্যিই প্রভু হও, তবে তা পশ্চিম দিক থেকে উদয় করাও।”

নমরূদ স্তব্ধ হয়ে গেল। সে কোন জবাব দিতে পারলো না। আল্লাহর হিকমতে সত্য প্রকাশ পেল।


মূর্তিভঙ্গের ঘটনা

একদিন শহরে বড় উৎসব হলো। সবাই বাইরে চলে গেল। ইবরাহীম (আ.) সুযোগ পেলেন। তিনি মন্দিরে ঢুকে সব ছোট-বড় মূর্তিগুলো ভেঙে ফেললেন। শুধু সবচেয়ে বড় মূর্তিটিকে অক্ষত রাখলেন, আর তার হাতে কুড়াল ঝুলিয়ে দিলেন।

লোকেরা ফিরে এসে মন্দির ভাঙাচোরা দেখে বিস্মিত হলো। তারা জিজ্ঞাসা করলো:
“এ কাজ কে করেছে?”

কেউ বলল: “ইবরাহীম নামে এক তরুণ এসব মূর্তির বিরোধিতা করে।”

তাকে ডেকে আনা হলো। ইবরাহীম (আ.) বললেন:
“দেখো, এই বড় মূর্তিটা কুড়াল হাতে আছে। নিশ্চয়ই সে-ই করেছে।”

লোকেরা বললো: “এটা তো অচেতন পাথর, কিছুই করতে পারে না।”

ইবরাহীম (আ.) বললেন:
“তাহলে কেন তোমরা এমন জিনিস পূজা করছ, যারা নিজেরাই কিছু করতে পারে না?”

সবাই চুপসে গেল। কিন্তু অহংকারে তারা সত্য গ্রহণ করলো না।


আগুনে নিক্ষেপ

নমরূদ ও তার লোকেরা রাগে ফেটে পড়লো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো—ইবরাহীম (আ.)-কে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করবে। বিশাল একটি চিতা তৈরি করা হলো। এত বড় আগুন জ্বালানো হলো যে, তার তাপ দূর থেকে অনুভূত হতো।

ইবরাহীম (আ.)-কে একটি মজবুত যন্ত্রে বেঁধে আগুনে নিক্ষেপ করা হলো। কিন্তু আল্লাহ হুকুম দিলেন:

“হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও শান্তি হয়ে যাও।”

আগুন তাকে বিন্দুমাত্র পোড়াতে পারলো না। বরং তিনি সেখানেই শান্তি অনুভব করলেন। লোকেরা অবাক হয়ে গেল। আল্লাহর কুদরত সবার সামনে প্রকাশ পেল।


পরিবার ও পরীক্ষা

পরবর্তীতে আল্লাহ ইবরাহীম (আ.)-কে পরিবার দিয়ে পরীক্ষা করলেন। তাঁর স্ত্রী হাজেরা (আ.) এবং ছোট ছেলে ইসমাইল (আ.)-কে নির্জন মরুভূমিতে রেখে যেতে আদেশ করলেন। তিনি আনুগত্য করে স্ত্রী-সন্তানকে মক্কার উষর ভূমিতে রেখে চলে গেলেন।

হাজেরা (আ.) বললেন:
“এ কোন স্থানে রেখে যাচ্ছেন?”

ইবরাহীম (আ.) বললেন:
“এ আল্লাহর হুকুম।”

হাজেরা (আ.) দৃঢ়ভাবে বললেন:
“তাহলে আল্লাহ আমাদের অপমান করবেন না।”

কিছুদিন পর পানির তীব্র প্রয়োজন দেখা দিল। হাজেরা (আ.) সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে দৌড়াতে লাগলেন পানির সন্ধানে। সপ্তমবার দৌড়ানোর পর হঠাৎ ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের গোড়ালি থেকে পানি ফোয়ারার মতো বের হলো। সেটাই হলো “জমজম কূপ”—যা আজও লক্ষ কোটি মানুষ পান করছে।


কুরবানীর পরীক্ষা

ইসমাইল (আ.) বড় হলে আল্লাহ আবার পরীক্ষা নিলেন। স্বপ্নে ইবরাহীম (আ.) দেখলেন—তিনি তাঁর ছেলেকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করছেন। তিনি ছেলেকে জানালেন।

ইসমাইল (আ.) দৃঢ়চিত্তে বললেন:
“পিতা, যা আদেশ পেয়েছেন, তা-ই করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।”

ইবরাহীম (আ.) ছেলেকে শুইয়ে দিলেন। ছুরিটি চালালেন। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে ছুরি চললো না। সাথে সাথেই আকাশ থেকে একটি দুম্বা পাঠানো হলো।

আল্লাহ ঘোষণা দিলেন:
“হে ইবরাহীম, তুমি পরীক্ষা পূর্ণ করেছ।”

এভাবেই কুরবানীর সুন্নত শুরু হয়, যা আজও মুসলমানরা পালন করে।


কাবা নির্মাণ

পরে আল্লাহর আদেশে ইবরাহীম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) কাবা ঘর নির্মাণ করেন। তাঁরা দোয়া করলেন:

“হে আল্লাহ, আমাদের থেকে এ কাজ কবুল করুন।”

এ ঘর আজও সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কিবলা।


শিক্ষা

ইবরাহীম (আ.)-এর কাহিনী আমাদের শেখায়:

  1. আল্লাহ একমাত্র রবঅন্য কারো উপাসনা নেই।
  2. সত্যের পথে অটল থাকতে হবে, যদিও পুরো দুনিয়া বিরোধিতা করে।
  3. আল্লাহর উপর ভরসা রাখলে সবচেয়ে বড় বিপদও শান্তিতে রূপ নেয়।
  4. পরিবারের ধৈর্যহাজেরা (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর ধৈর্য আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত।
  5. কুরবানী মানে আত্মসমর্পণআল্লাহর আদেশকে নিজের ইচ্ছার উপর অগ্রাধিকার দেওয়া।


উপসংহার

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুরো জীবন একটি দাওয়াত—এক আল্লাহর ইবাদত করা, মিথ্যা ত্যাগ করা এবং সত্যকে আঁকড়ে ধরা। তাঁর ধৈর্য, সাহস ও ঈমান আমাদের জন্য চিরন্তন আদর্শ।

আল্লাহ বলেন:
“নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন এক উম্মাহ।”

অতএব, আমরাও যেন তাঁর মতো আল্লাহর উপর ভরসা রাখি এবং জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় সফল হই।


Post a Comment

0 Comments